বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাগর রহমান

টি-টুয়েন্টি খেলায় কল্যাণপুরের অবদানের নেপথ্যে



কল্যাণপুরে ক্রিকেট খেলা আমদানীর পূর্বে ডান্ডা সদৃশ লাঠির ব্যবহার দেখা যেত গরুর পিঠে এবং ড্যাংবাড়ি (ডাংগুলি) খেলায়। লাঠির বাড়ি খেয়ে গরু গুলো হাম্বা হাম্বা স্বরে এবং ড্যাংবাড়ি খেলতে খেলতে ছেলেরা বাড়ি, দুড়ি, তেড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক, মেক গুনতে গুনতে চেঁচাত।
তারপর একদিন দিন বদলাল; হুড়মুড় করে কল্যাণপুরে ক্রিকেট খেলা ঢুকে পড়লো।
তখন, কল্যাণপুরের হাড় জিরজিরে ছেলেরা গরুর পাছায় লাঠি মারা এবং ডাংগুলির বাড়ি-দুড়ি ছেড়ে, পাঁজর ফুলিয়ে চার-ছক্কা মারতে শুরু করলো। দিন কতক যেতে না যেতে কল্যাণপুরবাসী একে অপরকে বলাবলি শুরু করলো, বিটিশগো খেলা রে ভাই, বিশাল বেরেনি খেলা। তারা ব্রিটিশদের ব্রেইনি খেলায় মশগুল হয়ে গেলে, খেলা শেষে গা জুড়াতে বসে গ্রামে এ খেলাটির আমদানীকারক ও প্রচলনকারী মোশাররফের গুণ গাইতে গাইতে বলতে লাগলো, ঢাকা তন একটা ভাল জিনিস আনছে পোলাটায়। এবং এ প্রসংগে গ্রামে ক্রিকেট প্রচলনের প্রথম দিনটির কথাও তাদের স্পষ্ট করে মনে পড়তে লাগলো:
দিনটি ছিল শনিবার। বাদ আছর। একতা সংঘের সামনে ছোট্ট মাঠে বদির গ্রুপ বনাম বশির গ্রুপ ডাংগুলি খেলছিল।
বদি বলে বেড়াতো, বইশ্যা আমার লগে পারবো মনে করছোস? কেনে আঙুল দিয়া খেলমু বেটা।
বশির বলে বেড়াতো, বইদ্যা আ কইরা চাইয়া থাকবো, ডান্ডার এক বাড়ি দিয়া ফুত্তিরে দরিয়ার ঐ পারে পাডামু। আমার লগে সেয়ানামি?
বদি বলে বেড়াতো, বইশ্যাতো ডান্ডাই ধরতে পারে না। বাড়ি দুড়ি তেড়ি চাঘল গুনতে গিয়া উলট পালট করে। হের কাম বুঝি আমার লগে খেলন?
বশির বলে বেড়াতো, বইদ্যার লগে খেলতে আমার গর্ত-মর্ত কিচ্ছু লাগতো না। গর্ত ছাড়াই ফুত্তি সমান মাটির উপর শোয়াইয়া বাইড়ামু। কইছ বইদ্যারে।
এভাবে বদি এবং বশির পরস্পরকে ডাংগুলি খেলার ব্যাপারে হুমকি-ধামকি দিতে থাকলে, এ ব্যাপারে একটা শ্রেষ্ঠত্বের ফায়সালা দরকার হয়ে পড়ে। তখন একতা সংগের পোলাপাইনে ঠিক করে, হোক, একটা ম্যাচ হোক। বদি গ্রুপ বনাম বশির গ্রুপ।
এবং খালি খালি তো ম্যাচ হয় না। বেটও ধরা লাগে। তখন তারা ঠিক করে, তাইলে ঠাণ্ডা খাওনের বেট হোক। দুই লিটারের বাজি।
এই মর্মে এক লিটার করে দুইটি ঠাণ্ডা, মানে ‘কোকাকোলা’ পানীয় বোতলের বাজিতে শনিবার বাদ আছর একতা সংঘের সামনের মাঠে বদি গ্রুপ বনাম বশির গ্রুপের ডাংগুলি খেলার আয়োজন করা হয়। যদিও কল্যাণপুর বাজারে যে কোক পাওয়া যায়, তা ঠাণ্ডা হওয়ার উপায় নেই। বাজারে কারেন্ট না থাকায় ফ্রিজ নেই, এবং ফ্রিজ না থাকায় যে সব কোকাকোলা পাওয়া যায়, তা ঠাণ্ডা হয় না। তবু তারা কোকের বাজি ধরলে বলে ‘ঠাণ্ডা খাওনের বাজি’ এবং বাজার থেকে কোকাকোলার বোতল কিনে এনে খালের পানিতে কচুরীপানার নিচে ডুবিয়ে রাখে ঘন্টা তিনেক। পানীয়টি কচুরীপানার ছায়ার নীচে থেকে মোলায়েম রকম ঠাণ্ডা হয়, আর বাজির জয় পরাজয় নির্ধারণ হয়ে গেলে, বিজয়ী পক্ষ খালের পানিতে চুবানো ঠাণ্ডা খেয়ে, এবং বিজিত পক্ষ মুন্সী বাড়ির ডিপ টিউবওয়েলের পানি খেয়ে ওক্ক করে ঢেঁকুর তোলে।
সুতরাং, ম্যাচের দিন, শনিবার বাদ আছর ‘বদির গ্রুপ’ এবং ‘বশির গ্রুপ’ বাড়ি, দুড়ি, কড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক, মেক গুনতে গুনতে তার স্বরে চেঁচাতে লাগল। দুই দলের ‘গুটে’র হিসাব রাখার জন্য কল্যাণপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের সেকেন্ড বয় নিজাম-উদ-দৌলাকে হায়ার করা হলো। ফার্স্ট বয় আব্দুর সোবহানকে হিসাব রাখার দায়িত্ব দেয়াই উচিত ছিল, তবে কি-না সে বদির মামাতো ভাই হয়, হিসাব রাখার দায়িত্ব একজন নিরপেক্ষ লোকের হাতেই হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন লতিফ জোয়ার্দ্দার। তিনি আজকের বিশেষ অতিথি, পেছনের দিকে হেলানো তার নিজস্ব আরাম কেদারা তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন। তাতে বসে বসে নানাবিধ বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। মতামতের সাথে সাথে তার গলা সপ্তমে চড়ে সময়ে সময়ে, তিনি আধশোয়া অবস্থা হতে লাফ দিয়ে উঠেন, এবং নানাবিধ খিস্তি সহকারে একজন অভিজ্ঞ কোচের মতো কৌশল বাতলাতে থাকেন:
– এইটা, এইটা কি কইরলো পোলাটায়, এত সোজা মাইর, এত সোজা মাইর!
– দেখ দেখ, কান্ডটা দেখ, হারামজাদা এইটা কোন বাড়ির রে, ডা-া ধরতেও তো জানে না দেখি।
– বেকুবের বেকুব, এই পোলাটারে খেলায় নামাইছে যে, হেই বড় বেকুব।
– ওরে ফুত্তি এমনে নি বাড়ি মারে? তোর হাত বেঁকা নি রে ব্যাডা?
ইত্যাদি ইত্যাদি।
তার মুখ সমানে চলছেই। ব্যাপারটা শুধু এ বিষয় নিয়েই নয়। কল্যাণপুরের বড় দিঘীতে ভাগের মাছ মারা থেকে শুরু করে সর্ব বিষয়ের জমায়েতে লতিফ জোয়ার্দ্দার তার আরাম কেদারা নিয়ে গিয়ে বসেন, এবং বিষয়ে অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধমকা-ধমকি করতে থাকেন।
নিজাম-উদ-দৌলা হিসাব রাখার উত্তেজনায় ঘেমে গেছে, একটু পর পর তার গলা শোনা যায়, এই খাড়ান, খাড়ান, লেইখ্যা লই, লেইখ্যা লই।
দো-চালা ঘর এবং সামনের মাঠ কল্যাণপুরের উত্তেজনা পিয়াসী পুরুষরা খেলার উত্তেজনা ও হতাশা মোতাবেক ক্ষণে ক্ষণে আ-আ-আ কিংবা ও-ও-ও করে উঠে সমস্বরে। তখন আশেপাশের বাড়ির অতি উৎসাহী মহিলারাও নানাবিধ বেড়ার ফাঁক ফোঁকর গলে এদিকে চোখ রাখলে কেবলি মাথার নিচ থেকে ব্যাটা মাইনষের শরীরের পিছন দিক দেখতে পায়। এতগুলো ব্যাটা মাইনষের শরীরের পিছনের দিক দেখে দেখে তাদের বিমমিষা জাগে। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে তারা বলে, ‘দুত্তোরি তোর, বুড়া বুড়া ব্যাডাগুলায় কাম কাইজ ছাড়ি …’, কথার বাকি অংশটা শেষ হবার আগেই একটা বিকট শোর গোল শুরু হলো খেলার মাঠে।
লতিফ জোয়ার্দ্দারের মেঝ ছেলে মোশাররফ ইলিশ মাছের ডিম তরকারী দিয়ে ভরপেট ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছিল। ডাংগুলি খেলার চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেলে সে গত দুইদিনে প্রথমবারের মতো বাড়ির বাহির হয়। ঢাকার যাত্রাবাড়ি ডিগ্রি কলেজে দুই বছর ধরে পড়ার ফলে সে গ্রামে আসলে ডাঙা তোলা মাছের মতো অনুভব করে। দুইবছর আগে কিভাবে সে জিন্স প্যান্ট ছাড়া কল্যাণপুরের রাস্তায় বেরুতো, ভাবতেই তার কাছে অবাক লাগে। জিন্স প্যান্ট পরিহিত অন্য সঙ্গীর অভাবে সে গ্রামে বেড়াতে আসলে ঘর হতে বের হয় না। কিন্তু আজকে আর পারা গেল না। সে তড়িঘড়ি করে তার চিপা জিন্স প্যান্ট পরে একতা সংঘের সামনে এলো। তারপর চারদিকের উত্তেজনাকে চাপিয়ে শুদ্ধ ভাষায় যা বললো, এক লাইনে তার সারমর্ম: এইসব খেলা এখনও দুনিয়াতে আছে? আপনারা এইসব খেলা এখনও খেলেন?
তখন কল্যাণপুর বাসী থতমত খেয়ে যায়, তার কথার মর্মার্থ বোঝার জন্য তারা ঘেমে উঠা স্ব স্ব ঘাড় চুলকাতে থাকে। মর্মার্থ বোঝাবার জন্য মোশাররফ বেশিক্ষণ সময় অবশ্য নেয় না। চুলকানোর উদ্দেশ্যে তোলা লোকজনের হাত ঘাড় হতে নামতে না নামতেই মোশাররফ আবারও ঘোষণা দেয়: এইগুলান খেলা রাখেন দেখি। দুনিয়া কই গেছি গিয়া, আর আপনেরা এখনও লেত্রা পোলাপাইনের মতো বাড়ি দুড়ি চাঘল গনেন। এখন হইল ক্রিকেটের যুগ। শুনছেন ক্রিকেট খেলার নাম? হুহ হু।
উপস্থিত কেউ ক্রিকেট খেলার নাম শুনেছে কি না, এ প্রশ্নের পরে উচ্চারিত ‘হুহ হু’ ধ্বনিটি তার নাক এবং মুখ হতে এমন অবজ্ঞা ভরে বেরুয় যে, লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ ক্রিকেট খেলার নাম আলিঝালি শুনে থাকলেও ক্ষনিকের জন্য বিলকুল বিস্মৃত হয়ে যায়, এবং চারদিকে যে একটা উত্তেজনা চলছিল, তা থম মেরে যায় সহসা। মোশাররফের বাবা লতিফ জোয়ার্দ্দারের গলাই শোনা যায় প্রথম, কিরকেট আবার কি ধরনের খেলা মিয়া মোশাররফ জোয়ার্দ্দার?
ছেলের নামের আগে মিয়া এবং জোয়ার্দ্দার সহযোগ ছাড়া তিনি কখনও ডাকেন না, শত হলেও অত্র এলাকার একমাত্র টাউনে পড়া ছেলে তার, একটা আলাদা মর্যাদা তো তার পাওনাই।
এতক্ষণ মোশাররফের হাত তার জিন্সের প্যান্টের সামনের দুই পকেটে ঢোকানো ছিল, সে অবস্থাতেই সে উপরোক্ত বাক্য বর্ষন করছিলো জনতার উপর, এবার হাত দুটি বেরিয়ে এসে তার চুলে যায়। সে কয়েকবার চুলে তা দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আব্বা, ক্রিকেট খেলা বোঝাইতে হইলে জিনিসপাতি লাগবো, এমনে এমনে হইবো না। হুহ হু।
হুহ হু শব্দবন্ধ মোশাররফের আধুনিক কেতায় সর্বশেষ সংযোজন। এ ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় সে মাথার সামনের অংশটিকে এমনভাবে ঝোঁকায়, যাতে তার সামনের দিকে ল্যাঞ্জা বের হওয়া চুলও তাল দেয়। সুতরাং, উপস্থিত শ্রোতারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। মোশাররফ চারপাশে গোল হয়ে থাকা লোকজনের দিকে অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে তাকিয়ে আশ্বস্থ করার গলায় যোগ করে, পাইরবেন। একটু ব্রেইন থাকলেই পারবেন। বেশি জটিল কিছু না। ড্যাংবাড়ি খেলার সাথে মিল আছে। আগামী মাসে বাড়ি আসার সুমে জিনিসপাতি নিয়া আসমু ঢাকা থেকে।
এ আশ্বাস দিয়ে, উপস্থিত মানুষগুলোকে হতবিহ্বল চোখের সামনে মোশাররফ বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়। তার দুই হাত তখন জিন্স প্যান্টের দুই পকেটে।
বলা বাহুল্য, অতঃপর ড্যাংবাড়ি খেলার উত্তেজনা হঠাৎ কেমন ঝিমিয়ে আসে। লোকজন এ কোণায় ও কোণায় জটলা করে ‘কিরকেট খেলা’ সম্পর্কে আলোচনা করে। কিন্তু সে আলোচনায় ক্রিকেট সম্পর্কে কোন সারকথা ব্যক্ত না করতে পারায়, কল্যাণপুরবাসী সিদ্ধান্ত নেয়: তাইলে মাসখানিক ধৈর্য ধরি থাকি। দেখি, হেতে ঢাকা তন কি ডাইল আর কদু নিয়া আসে।
‘ডাইল আর কদু’ বলে নিজেদের ক্রিকেট সম্পর্কে অজ্ঞতাকে চাপা দিয়ে হাসাহাসির একটা ব্যর্থ চেষ্টা তারা করলেও এক মাস অপেক্ষা করতে হবে ভেবে মনটা দমে যায় তাদের।
এক মাস তারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে থাকে। কিংবা হয়তো দুই মাস চলে যায়, তিন মাস চলে যায়, এবং দীর্ঘদিন ড্যাংবাড়ি না খেলা তাদের হাতগুলোতে যখন নিশপিশানির পরিমাণ অসম্ভব রকম বেড়ে উঠে, তখনই এক শুভদিনে ঢাকা হতে মোশাররফ গ্রামে আসে, সাথে আসে একটা ব্যাট ও বল। আরেকটা ব্যাট বানানোর জন্য কয়েকজন মিলে দৌড় দেয় বাজারের জহির কাঠকলের পেছনে রাখা বাজে কাঠের জঞ্জালের দিকে। এবং আরো কয়েকজন মিলে লতিফ জোয়ার্দ্দারের অনুমতি সাপেক্ষে তার বরাবাঁশের মুড়ায় ঢুকে চিকন-দেখে-শক্তমক্ত বাঁশ কেটে নিয়ে আসে উইকেট বানাবে বলে।
এই সব আয়োজন হয়ে গেলে মাঘ মাসের এক পড়ো পড়ো বিকেলে একতা সংঘের মাঠের স্মৃতিতে ড্যাংবাড়ি খেলাটি চির দিনের জন্য ঢুকে পড়ে, তার বুকে জায়গা করে নেয় ক্রিকেট খেলা। সকাল সন্ধ্যায় জায়গাটিতে বাড়ি-দুড়ি-ছাগল-চম্পা-ঝেক-মেকের বদলে আউট-ক্যাচ-রান-এল বি ডব্লিউ-ইনিংস সহ যাবতীয় ভিনদেশী শব্দ এ দেশীয় উচ্চারণে শোনা যেতে থাকে। এই খেলা ভিন্ন এত দিন তারা কোন প্রাচীনে পড়ে ছিল Ñ তা ভেবে কল্যাণপুরবাসী রীতিমত বিব্রত বোধ করতে শুরু করে।

দুই.
কিন্তু ড্যাংবাড়ি ছেড়ে ক্রিকেট খেলার প্রচলন – আপাত নিরীহ এই পরিবৃত্তিক প্রক্রিয়াটি কল্যাণপুরবাসীর পোশাক-ঐতিহ্যে একটা সমস্যার জন্ম দেয়। এতদিন নানান ছাপা, রঙ, ডিজাইনের সুতি কিংবা প্রিন্ট কিংবা ট্রেটনের লুঙি পরে তারা ড্যাংবাড়ি খেলা খেলতো। খেলার শুরুতে সেসব লুঙি তারা মালকোঁচা মেরে রেখে দিতো, অথবা হাঁটুর উপর কাপড় ওঠা হারাম বিবেচনায় কেউ কেউ মালকোঁচা না মেরে হাঁটু পর্যন্ত খাটো করে লুঙিটি পরতো। কিন্তু খেলার উত্তেজনা মুহূর্তে অবশ্যম্ভাবী ভাবে লুঙির মালকোঁচার খুঁট খুলে পড়তো, বা হাঁটুর বহু উপরে উঠে পড়তো। আর এভাবেই তারা লুঙির তলায় ঢেকে দেয়া পরস্পরের শরীরের কোন অংশে শুকনো ঘা অথবা দাদ আছে, তা জেনে যেতো। প্রথম প্রথম মোশাররফের প্রবল আপত্তিজনক ঠাট্টা সত্ত্বেও তারা লুঙি পরেই ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। মোশাররফের বলা ‘লুঙি পরি ক্রিকেট খেলন ঠিক না, বিদাশী খেলা, খেলাটার একটা মান ইজ্জত তো আছে’ কথাটিকে তারা তেমন একটা আমলে নেয়নি। কল্যাণপুরে এমনিতেই প্যান্ট পরে কেউ রাস্তায় বের হলে তারা হাসাহাসি করে বলতো, তুই এই চুঙাটার ভিতর ঢুকছস কেমনে, ক চাই?
কিন্তু ক্রিকেট প্রচলনের সপ্তাহ তিনেক যেতে না যেতে বিপত্তিটা ঘটলো।
ভুঁইয়া বাড়ির মিনহাজুল একদিন বিকেলে খেলার সময় ক্যাচ ধরতে গিয়ে যখন বুঝতে পারে, ক্যাচটি সে ধরতে পারবে না। সে দ্রুত হাতে তার মালকোঁচা মারা লুঙির খুঁট খুলে লুঙিটিকে জালের মতো বলের নীচে পেতে দেয়। আর বলটিও সুরুত করে এসে তার পেতে রাখা লুঙির আশ্রয়ে ধরা পড়ে। যেহেতু বলটি মাটিতে পড়েনি, শূণ্যেই ধরা পড়েছে, তাই নিয়মানুযায়ী ব্যাটসম্যানকে আউট ঘোষনা করা হয়। আর তখুনি বিপত্তিটা লাগে। ক্রিকেট খেলায় লুঙি পেতে ক্যাচ ধরা জায়েয কি-না, এই নিয়ে দুই প্রতিপক্ষের মতে ভীষণ বিবাদ লেগে যায়। বিবাদের দিন কল্যাণপুরের ক্রিকেটের জনক মোশাররফ ছিল না, সে ইতিমধ্যে ঢাকায় চলে গেছে। তাই এ বিবাদটির কোন মীমাংসা করা তাদের পক্ষে সহজ হয় না। তারা তখন ‘কেন লুঙি পরে ক্রিকেট খেলা ঠিক না’ – তা কিছুটা বুঝতে পারে। তবু উত্তেজনা প্রশমিত হয় না। উত্তেজনার এক পর্যায়ে তাদের অজান্তেই ছয়টি উইকেট ও দুইটি ব্যাট মোট আটজন খেলোয়াড়ের হাতে হাতিয়ারের মতো উঠে আসলে ক্রিকেট খেলার ভিন্ন একটা মাজেজা তাদের মনে তিরিক করে ঢুকে পড়ে।
এ ঘটনার দিন তিনেকের মধ্যেই কল্যাণপুর হাটের মমিন খলিফার দোকানে উঠতি যুবা-পুরুষের লম্বা লাইন শুরু হয়। মমিন টেইলার প্রতি জনের কোমর আর লম্বার দৈর্ঘ্য ফিতায় মেপে তার খাতায় মাপগুলো টুকে নিতে নিতে পাখি পড়ার মতো বলে যায়, পেন্ট পিন্দবা ভালো কথা, কিন্তুক বেশী চেগাইয়ো না, তাইলে কিন্তুক মাঝখানের সেলাই খুলি যাইবো। তখন আবার আমারে দোষ দিয়ো না কইলাম।
অগত্যা তারা বেশী না চেগানোর ( পা বেশী ফাঁক করা) প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়। এবং স্বল্প দিনের মধ্যেই স্ব স্ব প্যান্ট পরে কল্যাণপুরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে শুরু করে। শুধু কল্যাণপুরের বুড়ো-বুড়িরা তাকিয়ে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায় আর ভাবে, এই সব পোলাপাইনগুলা এই চোঙা পিন্দি পেশাব করে কেমনে?

তিন.
কল্যানপুরের উঠতি যুবাপুরুষদের গণহারে এহেন চোঙা পরিধান ও সকাল সন্ধ্যা ক্রিকেট নিয়ে মেতে উঠাতে বয়োবৃদ্ধরা ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়।
ড্যাংবাড়ি খেলাটিকে তারা দেখতো গরুর পিঠে এবং পাছায় লাঠি চালানোর প্রায়োগিক অনুশীলন হিসেবে। কেননা, কথায় বলে জরু এবং গরুকে রাখতে হয় ডা-ার আগায়। হাল চাষ থেকে শুরু করে ফসল মাড়াই পর্যন্ত যাবতীয় কাজে ব্যবহৃত গ্রামের গরুগুলোর ত্যাদড়ামির খবর তাদের ভালই জানা আছে। লাঠি চালানোর অনুশীলন ভিন্ন এদেরকে যে সোজা রাখা যাবে না, তা তারা জানতো। এছাড়াও ড্যাংবাড়ি খেলার আরো একটা প্রয়োজনীয়তাও তারা খুঁজে পেতো। কল্যাণপুরের বাচ্চারা মক্তবে, স্কুলে এবং বাড়িতে নিয়মিতভাবে যথাক্রমে হুজুর, মাস্টার ও বাপ-মায়ের বেত্রাঘাত খেয়ে খেয়ে কলেমা-সুরা-কেরাত, অ য়ে অজগর ঐ আসছে তেড়ে এবং নানাবিধ আদব-লেহাজ শিখতো। আশৈশব এসব বেতের বাড়ি খাওয়ার ঝাল তাদের মনে জমা হতে থাকতো। তাই একটু বড়ো হতেই তারা ড্যাংবাড়ি খেলা ধরতো এবং মনের মধ্যে বিবিধ জমে থাকা ক্ষোভ ও ঝাল মিটাতো ‘ফুত্তি’কে পিটানোর মাধ্যমে।
কিন্তু এখন এই ড্যাংবাড়ি খেলা ছেড়ে ‘বিদাশী খেলা কিরিকেট’ খেললে কি লাভ হবে, তা খুঁজে না পেয়ে বয়োবৃদ্ধদের চিন্তার উদ্রেক হয়। তবে, এর উত্তর পেতে তাদের খুব বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয় না।
কল্যাণপুরে যখন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হতো, তখন প্রতিপক্ষের পোষ্টার ছেঁড়া, ভোটের বাক্স ভরা, প্রতিপক্ষের কোন অপপ্রচারকে প্রতিহত করা এবং একই সংগে ভোটারদের সমীহ আদায়ের জন্য দূরদুরান্তের গাঁ হতে লাঠিয়াল ভাড়া করে আনার প্রচলন ছিল।
ভোটের কয়েকদিন আগেই এই সব ভাড়াটে লাঠিয়ালরা কল্যাণপুরে টহল দিতে শুরু করতো। তাদের ঠাক-ঠমক, চাল-চলনে যে দৃপ্ততা ফুটে উঠতো, তাতে কল্যাণপুরবাসী মুগ্ধ হয়ে যেতো। কোন নির্বাচন শুরু হলেই তারা খবর নিতো, এবার কোন পক্ষ কোন গাঁ থেকে লাঠিয়ার আনছে, বা কয়জন আনছে? এ খবরের পুলকে তাদের শরীর গরম হয়ে উঠতো, ভিন গাঁয়ের লাঠিয়ালরা মিছিলে থাকলে তারা একদিন বিকেলে ‘দোয়াতকলম’ মার্কার জন্য এবং পরদিন বিকেলে ‘বটগাছ’ মার্কার জন্য ‘ভোট দিবেন কি সে?’ শ্লোগানে রাস্তা-ঘাট-মাঠ-হাট-বাট গরম করে ফেলতো। এবং নিজে কোন মার্কায় ভোট দিবে, তার সিদ্ধান্ত নিতে ভোটের আগের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। কোন মার্কায় লাঠিয়ালদের জোর বেশী বলে মনে হচ্ছে, কারা দরকার মতো ভোটের বাক্স কেড়ে নিয়ে ইচ্ছা মত সিল দিয়ে জিতে যেতে পারবে Ñ এই সব বিবেচনা করতো, প্রার্থীদের বরাদ্দ পান-বিড়ি-সিগারেট-মুড়ির গোল্লা-বেলা বিস্কুট খাওয়ানোটা না। কেননা, ভোট দেবার প্রতিশ্রুতি বাবদ খাওয়া-খাদ্য তাদের প্রাপ্য রিজিক বলেই তারা জানতো। তার চেয়ে বরং জোরওয়ালা মার্কায় ভোট দেয়াই ভালো, তারা বলাবলি করতো, ভোট পঁচাইয়া লাভ আছে নি কোন?
এ প্রক্রিয়ার ব্যতয় ঘটেছিল সেবার।
উনিশ শো পচাঁশির এক বৃহস্পতিবার কল্যাণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাঠটিতে তারা কোন রকম লাঠিয়ালের অংশগ্রহণ ছাড়াই ভোট দিতে উপস্থিত হয়। ভোটটিকে তারা বলে ‘ মেন্দা মারা ভোট, মার্কা নাই, গরমা-গরমি নাই, কিয়ের বোলে ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ ভোট? এইটা কোন মার্কা হইল?’ তবু তারা মনের সুখে ভোট দিতে যায়। কেবল তারা না, নানান বয়সী বাচ্চাদেরকেও তারা কাঁধে বসিয়ে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যায়। তখন তাদের দেখাদেখি বাচ্চারাও গোঁ ধরে বলে, ‘আব্বা, আমিও একটা ভোট দিমু।’ প্রথমে তারা ভাবে, এটা বোধহয় সম্ভব হবে না। সে মোতাবেক তারা বাচ্চাগুলোকে মৃদু ধমকে উঠে গুলগুলা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতিতে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করে। তারা বলে, ‘ধুর অ। ভোট দিয়া কি লাভ। তার চাইতে তোরে আবুলের দোকান থেকি গুলগুলা খাওয়ামু।’ বাচ্চাগুলো অন্যদিন হলে যে কোন কিছুর চাইতে গুলগুলা খেতে রাজি হয়ে শান্ত হয়ে যেতো। অথচ সেদিন কেন জানি গুলগুলার চাইতে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দেয়াটাকে তাদের অধিকতর উপাদেয় মনে হয়। তাই তাদের ঘ্যানর ঘ্যানর আর থামতেই চায় না। ভাগ্য গুণে সে নির্বাচনের পোলিং এজেন্টদের মন খুব নরম ছিল। তারা বাচ্চাদের কান্না শুনে ঠিক থাকতে পারতো না। তাই তারা বাচ্চাগুলোর আব্বাদেরকে বলে, ‘আরে দেক না, দেক একটা ভোট। অসুবিধা নাই। পোলাপাইনের একটা শখ। শখের দাম লাখ টেকা।’ এই সব বলতে বলতে ব্যালট পেপার বের করে ‘হ্যাঁ’ লেখা জায়গাটাতে একটা টিপ দিতে বলে। বাচ্চাগুলো মহানন্দে ‘হ্যাঁ’-এর উপরে আঙুলের টিপ দিতে থাকলে যুগপৎ বাচ্চাগুলো, তাদের বাবা এবং পোলিং এজেন্টদের মুখ স্বর্গীয় আনন্দে ভরে উঠতে তাকে।
সন্ধ্যা নাগাদ কল্যাণপুরের গ্যাঁদা-আ-া-ছানা বয়সী বাচ্চাদের সবগুলো আঙুল ভোটদাতা চিহ্নিত কালিতে রঙিন হয়ে উঠে। সবগুলো আঙুলেই কালি লাগে, কারণ ভোট দিতে তাদের খুব ভালো লেগেছিল, এবং একটা ভোট দিয়েই তারা পুর্নবার দেবার জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর জুড়ে দিয়েছিল। আর মন নরমওয়ালা এজেন্টরা মহা উৎসাহে বাচ্চাগুলোর দিকে ব্যালট পেপার এগিয়ে দিয়েছিল। এভাবে একেকজন আট দশটা করে ভোট দিয়ে, ভোটের কালি মাখা আঙুল মুখে ঢুকিয়ে চুষতে চুষতে মিছিল করে বেড়াতে লাগলো, ভোট দিবেন কী সে? হ্যাঁ মার্কা বাকসে।
যদিও এমন নিস্তেজ ভোটে কিছুক্ষনের মধ্যেই কল্যাণপুরের বয়স্কদের মন উঠে যায়, তারা পূর্বে উক্ত ‘মেন্দা মার্কা ভোট’টিকে এবারে ‘দুধ খাওয়া পোলাপাইনের ভোট’ আখ্যা দিয়ে এবং ভোট দেয়া বাদ দিয়ে নিজেরাই আবুলের দোকানে দুধ চা আর গুলগুলা খেতে খেতে হাসাহাসিতে মেতে উঠে।
এ মেন্দা মার্কা নির্বাচনের বছর খানেক পরেই তাদের আফসোস মিটিয়ে দেবার জন্য আরেকটি নির্বাচনের ঢেউ আছড়ে পড়ে তাদের জীবনে। এবং তখুনি মূলতঃ ক্রিকেট খেলাটার অতি প্রায়োগিক দিকটি তাদের কাছে ধরা পড়ে।

চার.
ক্রিকেট খেলা রপ্ত হয়ে যাবার পর থেকে কল্যাণপুরের চল্লিশের ধোক্কায় পড়ার ও বাতের ব্যথায় কাতর হওয়ার আগ পর্যন্ত যাবতীয় পুরুষেরা ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। তখন আবার ড্যাংগুলি খেলার চিরপ্রতিদ্বন্ধি ‘বদির গ্রুপ’ ও ‘বশির গ্রুপ’ পরস্পরের সাথে ছক্কা মারার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়।
বদি জোরসে ছক্কা মেরে তালগাছের আগায় বল তুলে দিয়ে বশিরকে দেখায়, ভাল করে চাইয়্যা দেখ, কেমনে ছক্কা মারতে হয়?
বশির ফিরতি ছক্কায় বলটিকে মিধ্যা বাড়ির দিঘির মাঝখানে পাঠিয়ে বলে, ছক্কা মারি গেরাম পার করি দিমু, আমার লগে টাল্টি বাল্টি?
বদি বলে বেড়ায়, টিমও লাগতো না ব্যাটা। আমি একলা খেলুম বইশ্যার টিমের লগে।
বশির বলে বেড়ায়, বইদ্যারে কইছ বস্তা লই আইতে খেলার সময়। রান বস্তাত বাইন্দা নিতে পারবো।
বদি বলে বেড়ায়, বইশ্যারে কইছ, শরীলে জোব্বা-জাব্বা বান্দি আসতে। আমি বল বাইড়ান ধরলে রে, মা মা কইয়া চিল্লাইবো।
বশির বলে বেড়ায়, বইদ্যার লগে দুই চোখ বান্ধি ব্যাট করমু। হে টেরও পাইবো না, চার ছক্কা হইব কোন দিক দিয়া।
দেখা যায়, সেই পুরনো ধারা মোতাবেক হুমকি ধামকি চলছেই। তখন তারা ঠিক করে, তাইলে পনের ওভার করি প্রতিযোগীতার খেলা হোক। তাইলেই কার হেডম কতদূর বোঝা যাইবো। ঠা-া খাওনের বেট।
এই হেতু বাজার হতে দুই লিটারের কোকাকোলার একটি বোতল এনে খালের কচুরিপানা ছাওয়া পানির তলে ডুবিয়ে কল্যাণপুর প্রাইমারী স্কুলের মাঠে ‘বেটের খেলা’ শুরু হয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, দিনটি ছিল রবিবার। ঊনিশশো ছিয়াশি সালের চৌঠা মে, একুশে বৈশাখ তেরোশো বিরানব্বই বঙ্গাব্দ।
কয়দিন ধরেই প্রতি বিকেলে বিকেলে আকাশ কালো করে আসছিল আর আচমকা কালবৈশাখী শুরু হয়ে যাচ্ছিল। এ আশংকায় একতা সংঘের পক্ষ হতে চাঁদা তুলে শুক্কুরবার মসজিদে মিলাদও পড়ানো হয় যাতে আকাশ পরিষ্কার থাকে। মসজিদের ইউনুস মাওলানা দুয়েকবার খেলাধূলার জন্য মিলাদ পড়ানো ঠিক হবে কি না ভেবে ইতস্তত করেছিলেন, তখন লতিফ জোয়ার্দ্দার (যিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি) হুজুরকে মৃদু ভৎর্সনা করে বললেন, ‘পোলাপাইনের একটা শখ। শখ মিটানোও একটা ছওয়াবের কাজ, সে উপলক্ষ্যে মিলাদ পড়া হইবো, ছওয়াবতো দ্বিগুন হইব। কি গোঁ গোঁ করেন।’ এ কথায় কাজ হয় তুরগ গতিতে, ইউনুস মাওলানা আর কোন কথা না বাড়িয়ে সুরেলা গলায় শুরু করে দেন, ইয়া নাবী সালা মালাইকা…
রবিবার দিন সকালে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হলে তারা মনে মনে ভাবতে শুরু করলো, তবে কি মিলাদের নারিকেলি বিস্কুট খাওয়ানো বাবদ বার টাকা আর হুজুরকে দেয়া পাঁচটাকা মিলিয়ে পুরো সতের টাকা জলে গেলো? দোয়ায় তাইলে কাজ হইলো না? কিন্তু দুপুর গড়াতে না গড়াতেই তাদের আশংকা মিথ্যে প্রমাণ করে সারা আকাশ হতে মেঘ সরে গিয়ে ঝকঝকা রোদ উঠলো, এবং তারা দলে দলে কল্যাণপুর প্রাইমারী স্কুলের মাঠে জমা হতে লাগলো।
অবশ্য মাঠে দলে দলে জমায়েত হতে তাদের আলাদা কষ্ট করে দল পাকাতে হয়নি। গত কিছুদিন ধরে তারা দলে দলেই ঘুরছিল। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে জাতীয় নির্বাচনের ঢেউতে যে বিয়ে লাগার মতো সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল, তার ধাক্কায় কল্যাণপুরের যাবতীয় দোকান পাট, ঘরের বেড়া, পায়খানার পর্দা, স্কুলের দেয়াল সহ জায়গা-অজায়গায় নানাবিধ মার্কাকে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ-হুমকি-ধামকি উৎকীর্ণ হতে দেখা যাচ্ছিল। এক বছর আগের মেন্দা মার্কা ভোটটির যাবতীয় শোক ভুলিয়ে দিতেই যেন নানান প্রতীক, ব্যানার, পোষ্টার, টুপি, কোট-প্যান্ট, শেরোওয়ানীতে ছয়লাপ হয়ে যায় চারদিকে। স্কুলের মাঠে খেলা দেখতে জমায়েত হলে তারা দেখতে পায় সমগ্র স্কুল, স্কুলের মাঠ সাজানো। মাঠের এপাশ হতে ওপাশ লম্বা লম্বা টানানো দড়িতে নানান পোষ্টার আর ব্যানারে শোভিত। তখন তাদের মনে পড়ে, আরে দুই দিন পরে এই স্কুলের মাঠেই ভোট হইব। এ রঙিন সাজে দর্শক এবং খেলোয়াড়দের মন অতি প্রফুল্ল হয়ে উঠে। তারা জেয়াফত খাবার আনন্দে মেতে উঠার মতো হেসে উঠে।
কিন্তু, খেলা শুরু হতেই শুরু হয় বিপত্তি।
ছক্কা মারতে না পারলে ক্রিকেট খেলায় সুখ নাই, সম্মানও নাই। তাই প্রথমে টসে জিতে যখন বশির গ্রুপের দল ব্যাট করতে নামে, নেমেই তারা দমাদম ছক্কা হাঁকাতে যায়। অথচ ছক্কা হাঁকাতে গেলেই বল গিয়ে লাগে উপরে টানানো কোন পোষ্টারে, লেগে ‘ফটাস’ করে শব্দ হয়। সে শব্দে তাবত লোকজন হেসে উঠে, পোষ্টারটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। আর ত্যাদড় বলটি গিয়ে লাগে হয় পোষ্টারে ছাপানো নূরানী চেহারার প্রার্থীর গাল ফোলা চোয়ালে, না হলে ’অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’ শ্লোগানে। একটা করে পোষ্টার ফেটে চৌচির হয়, আর সবাই হুড়াহুড়ি করে দেখতে যায় বলটি গালে লেগেছে না চরিত্রে। তখন তারা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে পরস্পর বলাবলি করতে থাকে, ‘দেখ দেখি, ছক্কা লাগি অমুক কেরুম ভ্যাটকাইয়া রইছে, হা হা হা হা।’ অথবা, ‘ছক্কাটায় অমুকের চরিত্রে কালি লাগাইয়া দিছে, ছিঁড়ি ভিতরের খবর সব বাহির হই গেছে, হি হি হি।’
এ হাসি ঠাট্টায় বদির গ্রুপ যোগ দিলেও বশির গ্রুপের ব্যাটসম্যানরা এ দূর্গতিতে মারাতœক ব্যাজার হয়। সারা মাঠ জুড়ে ফটাস ফটাস শব্দ শোনা যেতে থাকে কিন্তু ছক্কার দেখা পাওয়া যায় না। তখন তারা বদির গ্রুপকে বলে, ‘দেখি, তোরা কেমনে ছক্কা মারস।’ কিছুক্ষণ পর বদির গ্রুপ যখন ব্যাটিং করতে শুরু করে, দেখা যায় সমান রকম বিপত্তি তাদেরকেও পেয়ে বসে, কেননা, মাঠে পোষ্টারের কোন কমতি ছিল না। তারাও সমানে ছক্কা মারতে থাকে, আর এ কোণায় ও কোণায় ফটাস ফটাস করে কোন প্রার্থীর গালে লাগে, কোন প্রার্থীর চরিত্রে লেগে চেহারা ভ্যাটকাতে থাকে, অথবা চরিত্রের ভিতরের খবর বের হতে থাকে।
এ অবস্থায় যেহেতু স্বাভাবিক জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা দুরুহ হয়ে পড়ে, তখন তারা মাটে উপস্থিত প্রধান অতিথি লতিফ জোয়ার্দ্দারের শরনাপন্ন হয়। লতিফ জোয়ার্দ্দার তার আরাম কেদারাটিতে বসে খেলোয়াড়দেরকে অভ্যাসমত টিপস দিয়ে যাচ্ছিলেন। সমস্যা গুরুতর বিবেচনায় তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করেন। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি দেন: তাইলে এক কাম কর, রান-টান বাদ দাও। ফাটা-ফাটির খেলা খেল।
সিদ্ধান্তটি হয় এরকম: যে দল যত বেশি পোষ্টার ফাটাতে পারবে, সে দল জয়ী হবে।
এ দারুণ আইডিয়ায় আবার প্রথম থেকে খেলা শুরু হয়। এবারে ব্যাটসম্যানরা চার-ছক্কা মেরে রান করা বাদ দিয়ে উপরে টানানো পোষ্টার লক্ষ্য করে ব্যাট করতে থাকে, আর একটা একটা করে পোষ্টার ফেটে চৌচির হয়ে উড়তে থাকে আকাশে বাতাসে।

পাঁচ.
সেই প্রথম কল্যাণপুরের জনগণ বুঝতে পারে, ছক্কা মেরে নির্বাচনের পোষ্টার ফাটানো কত আনন্দের!
একই সংগে আরেকটা গূঢ় আনন্দও তাদের চোখে ধরা পড়ে।
এই যে পোষ্টারের পর পোষ্টার জুড়ে নূরানী চেহারা আর ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রের ছড়াছড়ি, তাদের প্রতি একটা বিজাতীয় বিতৃষ্ণা তাদের সবসময়ই ছিলো। কল্যাণপুরের যে কোন অধিবাসীকে জিজ্ঞেস করলেই, সে জিকির করার মতো এক দমে বলে যেতে পারবে: কোন চেয়ারম্যানের আমলে কত বস্তা গম তাদের জন্য এসেছিলো, এবং কয় কেজি তাদের মধ্যে বিতরণ হয়েছিল; কোন চেয়ারম্যান শুধু তার বাড়ির সামনের রাস্তায় মাটি ফেলে পাহাড়ের মতো উঁচু করে তুলেছিল, যেখানে কল্যাণপুরের বড় রাস্তায় এখনো একটু বৃষ্টিতেই পানি উঠে যায়; কোন মেম্বার টাকা খেয়ে কার তালগাছ আরেকজনের বলে রায় দিয়েছিল কোন সালিশে Ñ এমনি হাজারো নালিশ যা মুখ ফুটে বলার মতো মাথা তাদের ঘাড়ের উপর একটাই আছে বিবেচনায় বলার সাহস পায়নি সারাজীবন। এখন ছক্কা মেরে তাদের পোষ্টার ফাটিয়ে ঝাল তোলার একটা অবাধ সুযোগ এসে যাওয়ায় ক্রিকেট খেলাটির প্রায়োগিক দিকটি এলাকার চিন্তিত বৃদ্ধদের চিন্তা দূর করে দেয় অবশেষে। তারাও ক্রিকেটের ভক্ত হয়ে পড়ে সহসা। অচিরেই খেলোয়াড়রা স্কুলের মাঠ ছেড়ে সারা এলাকায় যত পোষ্টার আছে সেসব ফাটাতে শুরু করে, এবং এক পর্যায়ে সব পোস্টার ফাটিয়ে ভীষণ মুষড়ে পড়ে। তাদের মনে হয়: হায় হায় রে! ফাটানোর জন্য পোষ্টার পামু কই এখন? এলাকার ছেলেপুলেদের এমন মুষড়ে পড়ায় গ্রামের মুরুব্বীরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা ছেলেপুলেদের সান্তনা দেয়, চিন্তা কইরো না, বেশি দেরি নাই, আবার নির্বাচন আইবো, দিন যত যাইবো গাল ফোলা প্রার্থীর সংখ্যাও বাড়বো, চরিত্র আরো পবিত্র হইতে থাকবো, পোষ্টারও অনেক বাড়বো। দেখবা তখন ফাটাইতে আরো মজা পাইবা। খালি ছক্কা মারবা আর পোষ্টার ফাটাইবা। তোমরা খালি ছক্কা মারার অভ্যাসটা চালাইয়া যাও। দিনতো সবে শুরু, সামনে আরো দিন আসতেছে।
মুরুব্বীদের এসব কথায় ছেলেপুলেরা প্রথম প্রথম খুব একটা আমলে নেয় না। তারা জানে, তাদেরকে ভুলিয়ে রাখার জন্য মুরুব্বীরা এমন কত কথাই না বলে। তবু ক্ষীণ আশাতেই তার ছক্কা মারার অভ্যাসটা চালিয়ে যাচ্ছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কল্যাণপুরের মুরুব্বীরা মিথ্যে আশ্বাস দেন নাই।
সেই নির্বাচনের পাঁচ মাস পর আরেকটা, সোয়া বছর বাদে আরেকটা, বছর দেড়েক বাদে আরেকটা Ñ মোটকথা একটার পর একটা নির্বাচন শুরু হয়। একটা প্যাঁচ লাগে, তা খুলতে একটা নির্বাচন হয়, তখন পুরনো প্যাঁচ খোলার আগেই আরেকটা প্যাঁচ লেগে যায়, তা খুলতে কয়দিন পর আরেকটা নির্বাচন শুরু হয়। জাতীয়, উপ, অন্তবর্তী নির্বাচনের সাথে পাল্লা দিয়ে দলের সংখ্যা বাড়ে। দল বাড়লে মার্কা বাড়ে। মার্কার অনুপাতে প্রার্থী বাড়ে, এর এসব প্রার্থীদের চেহারার নূরে আকাশে বাতাসে বেদিশা বেদিশা ভাব প্রকট হয়ে উঠে। তাদের গাল ও ভূঁড়ি ক্রমশঃ স্ফীত হতে দেখা যায়, সাথে সাথে তাদের চরিত্রও পবিত্রতর হয়ে উঠতে থাকে।
এভাবে নির্বাচন বাড়ে, মার্কা বাড়ে, প্রার্থী বাড়ে, পোষ্টারের সাইজ বাড়ে, পোষ্টারের সংখ্যা বাড়ে, আর সংখ্যা বাড়লে বেশি ফাটানোর সুযোগ পাওয়া যায়, বেশি ফাটালে বেশি মজা পাওয়া যায়। ঠিক এমন মধুর সময়ের ও সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো কল্যাণপুরের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা। তারাও মনের সুখে ছক্কা মেরে মেরে যাবতীয় প্রার্থীর চেহারা ও তাদের চরিত্রের সার্টিফিকেট ধারী পোষ্টারগুলোকে ‘ভ্যাটকাইয়া’ দিয়ে ধুনে তুলা তুলা করে দিতে থাকে। আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াতে থাকে পোষ্টারের কংকাল।

উপসংহার:
সেই থেকে কল্যাণপুরে পোষ্টার লাগানোর ব্যাপারে ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা দিতে শুরু করে। তারা উদাস হয়ে বলে, ‘থাক, পোষ্টার লাগানোর কাম নাইকা। এ এলাকায় এমনিই ভোট হইব।’ এসময় তাদের চোখ যুগপৎ নির্ঘুম, ফোলা ফোলা ও লাল লাল দেখা যায়। কেননা, দেখা গেছে, ভোটে দাঁড়ানোর দিন থেকেই তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। একটু ঝিমুনি আসলেই ‘ফটাস, ফটাস, ফটাস’ শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে তার ফোলা গালে হাত বোলায়, আর দুঃস্বপ্ন দেখার আতংক নিয়ে জেগে বসে থাকে।

পাদটীকা:
কল্যাণপুরের এই গূঢ় ইতিহাসটি বর্তমান কাহিনীকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়ে পড়লে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সরেজমিনে কল্যাণপুর পরিদর্শন শেষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছে একটি দীর্ঘ স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপিটির কিছু অংশ নিচে উদ্ধৃত হলো :
“… এতএব মহোদয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নয়নে, বিশেষত টি২০ এর মতো ধুমধাড়াক্কা খেলায় আমাদের অনগ্রসরতা ও অদক্ষতার উন্নয়নকল্পে সারাদেশ জুড়ে আরো শত শত দলের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হোক। এবং এসব নির্বাচনে ভূঁড়িওয়ালা, গালফোলা, খোদার খাসীটাইপ প্রার্থীদেরকে মনোনয়ন দেয়া হোক, যাতে কল্যাণপুরের উদ্যোমী জনগণের মতো সারাদেশের জনগন চার-ছক্কা প্র্যাকটিসের অবাধ সুযোগ পায়। কেননা আমাদের কৌতূহলের মুখে তারা জানিয়েছে যে, এ জাতীয় প্রার্থীদের গাল ও চরিত্র লক্ষ্য করে ছক্কা হাঁকাতে তারা অতিশয় উৎসাহিত বোধ করে। আমরা নিশ্চিত, এর প্রভাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আন্তজার্তিক মানের ধুমধাড়াক্কা ব্যাটসম্যান বেরিয়ে এসে টি২০ খেলায় আমাদের ক্রিকেটকে তথা দেশের সম্মানকে জগৎবাসীর কাছে…”

বি. দ্র: হাতের কাছে স্মারক লিপিটির কোন কপি না থাকাতে উপরের উদ্ধৃতিটি স্মৃতি হতে লেখা হলো, তাই বাক্যগুলোতে কিছু শব্দ এলোমেলো হতে পারে, এজন্য এই কাহিনীকার আন্তরিক ভাবে দুঃখিত)

সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি :

সাগর রহমান

সাগর রহমানের জন্ম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে। পিতা – নুরনবী চৌধুরী, মাতা – রোকেয়া বেগম। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা সাগর রহমানের লেখালেখি শুরু স্কুল জীবন থেকে। তারপর থেকে নিয়মিত লিখছেন বিভিন্ন ছোটকাগজ সহ নানান দৈনিকে, সাপ্তাহিক কাগজে, ব্লগে, অনলাইন ম্যাগাজিনে। মূলত গদ্যকার হলেও কবিতা, ছড়া, মুক্তগদ্য লিখেছেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ: খড়িমাটির দাগ (গল্প গ্রন্থ), হিঁদোলচোরা (উপন্যাস), টুপটাপের বাড়ি ফেরা (শিশুতোষ উপন্যাস)।
২০১৯ বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় সাগর রহমানের দুটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। উপন্যাস: কৃষ্ণপক্ষের দিনরাত্রি ( অনার্য পাবলিকেশন্স), অদ্ভুতুড়ে উপন্যাস: দুই ভূত, অদ্ভুত ( ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ)।
লেখকের ইমেইল: goddoshagor@gmail.com

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!