বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

বরেণ্য বুযুর্গ আল্লামা নুরউদ্দীন আহমদ গহরপুুরী (রহ.)-এর ১৭তম ওফাত দিবস আজ



বরেণ্য বুযুর্গ হাফিজ আল্লামা নুরউদ্দীন আহমদ গহরপুুরী (রহ.)-এর ১৭তম ওফাত দিবস আজ। উপমহাদেশের যে সমস্ত মহামনীষী দ্বীন ইসলামের খেদমত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করে মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাদেরই অন্যতম একজন বরেণ্য বুযুর্গ হাফিজ আল্লামা নুরউদ্দীন আহমদ গহরপুুরী (রহ.)। তিনি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার শিওরখাল মোল্লাপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা জহুরউদ্দিন ছিলেন পরহেজগার সমাজ সচেতন বিজ্ঞ আলেম। তিনি আজীবন দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর মাতা ছুরতুন্নেসা ছিলেন ইবাদাত গুজারী পরহেজগার এক মহিয়ষী বিদুষী নারী। গহরপুরী শিশু বয়সেই তাঁর পিতাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যান। মায়ের আদর-স্নেহ আর দোয়াই তাঁর পাথেয় হিসেবে কাজ করে।

শিক্ষা জীবন: পরিবারে দ্বীনের চর্চা ছিল বিধায় নিজ পরিবারেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। এক সময় তাঁকে পাশের গ্রামের সুলতানপুর মক্তবে ভর্তি করে দেয়া হয়। এরপর তিনি পুর্বভাগ জালালপুর মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেন। তৎকালিন সময়ে বৃহত্তর সিলেটের বিখ্যাত বুযুর্গ বাঘার শায়েখ সাহেব মাওলানা বশির উদ্দিনের যাতায়াত ছিল গহরপুরে। আলেম ও দ্বীনদার পরিবার হিসেবে গহরপুরীর বাড়িতেই তিনি যাতায়াত করতেন। মাওলানা বশির উদ্দিন ছিলেন শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানীর (রহ.)-এর খলিফা। একবার তিনি গহরপুরীর বাড়িতে আসলে শিশু নুরুদ্দীনকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার আবেগে আপ্লুত মুহতারামা ছুরতুন্নিসা শায়খে বাঘার কাছে আরজ করলেন তার ছেলের লেখাপড়া ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অভিবাবকত্ব নেওয়ার জন্য। শায়খ মহিয়ষী এক জননীর আবেদনে সাড়া দিলেন। তিনি শিশু নুরউদ্দীনকে সাথে করে নিয়ে গেলেন এবং বাঘা মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। শিশু নুরুদ্দীন লেখাপড়ার পাশাপাশি হযরত শায়খে বাঘার খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন। কিশোর বয়সেই বাঘার খাদিম হিসেবে তাঁর পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তিনি হিফযুল কুরআন সমাপ্ত করেন।

মনের ঐকান্তিকতা আর আল্লাহতাআলার প্রদত্ত প্রখর মেধাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ঘুমকে হারাম করে শায়খ ঘুমানোর পর রাতে কুরআন মজীদ হিফজ করতেন। এক রাতে কি এক কারনে শায়খ সাহেব কিশোর নুরউদ্দীনকে শাসন করতে গিয়ে প্রহার করলেন। এরপর বিষয়টি শায়খের মনে দাগ কাটতে লাগল। তিনি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। নুরউদ্দীনকে ডেকে পাঠালে দেখতে পান তাঁর মুখে মৃদু হাসি, মনে কোন দুঃখ নেই, ক্ষোভ নেই। শায়খে বাঘা গভীর মমতায় অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন বালক নুরুদ্দীনের দিকে। তার ভবিষ্যত কল্যাণ চিন্তায় তাঁর মন দুমড়ে কেঁদে উঠে। তিনি মহান আল্লাহর দরবারে তার জন্য বিশেষ মোনাজাত করেন। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে গহরপুরীকে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাপিট দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। ইতোমধ্যে ভারত স্বাধীন হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্থান। রেফারেন্ডারের মাধ্যমে সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়।

জানাগেছে, গহরপুরী ১৯৫০ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস ১ম বিভাগে ১ম স্থান অর্জন করেন। দেওবন্দ থাকাকালিন অবস্থায় তিনি তাঁর আদব-আখলাক ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে উস্তাদগনের মন জয় করেন। বিশেষত, উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর নৈকট্য হাসিল করতে সক্ষম হন। ইলমে হাদিসের প্রতি ছিল তার বিশেষ অনুরাগ। ফলে দাওরা পাশ করে তিনি আরো এক বছর হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্র গবেষণায় অতিবাহিত করেন। শায়খুল ইসলাম মাদানী ছাড়াও তিনি দেওবন্দের যেসব জগৎ বিখ্যাত মনীষীদের শীর্ষত্ব লাভ করেন তাঁরা হলেন – ক্বারী তৈয়্যব (রহ.), শায়খুল আদব মাওলানা এজাজ আলী আমরুহী (রহ.), মাওলানা ইব্রাহিম বলিয়াভী (রহ.), মাওলানা মেরাজুল হক (রহ.), মাওলানা ফখরুল হাসান (রহ.) মুরাদাবাদী।

লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষাজীবন ছাড়াই আজীবন তাঁর গভীর মনোযোগ ছিল। দেওবন্দেই তিনি তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখেন এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষনে সক্ষম হন। তিনি ফারিগ হওয়ার পরই মাদানী (রহ.) এর হাতে বায়াত হন। আধ্যাত্বিক উন্নতি ও পরিশুদ্ধি সাধনায় রত হন।

কর্ম জীবন: ১৯৫২ সালে স্থায়ী পীর ও উস্তাদ মাদানী (রহ.) ও শায়খুল আদব এজাজ আলী (রহ.) এর নির্দেশে মাওলানা গহরপুরীকে সরকারী শায়খুল হাদীস পদে বরিশালের পাঙ্গাসিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় প্রেরণ করা হয়। এর পূর্বে শায়খুল হাদীস ছেড়ে দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ আবেদন করেছিলেন। এ নিয়োগ ছিল এক বিরল ঘটনা। সরকারী শায়খুল হাদীস পদের জন্য প্রেরণের ঘটনায় ইলমে হাদীসের পরিলক্ষতার বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি নিজে নিজে কুরআন শরীফ হিফজ করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন। শায়খে বাঘা রমজানের খতমে তারাবির জন্য হাফিজ সাহেব তালাশের কথা বলেন। তিনি জানান যে তেইস পারা তিনি মুখস্ত করেছেন। বাকি সাত পারা তিনি সাত দিনেই মুখস্ত করে নামাজ পড়িয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

একদা আল্লামা গহরপুরী (রহ.) হাদীস পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ উটে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জমিতে দুটি সাপকে বেদম প্রহার করলেন। পরে সাপ মারার কারন জানতে চাইলে বললেন, ওরা দুটি জ্বীন, প্রতিদিন আমার কাছে পড়তে আসে। প্রায়ই ওরা পরস্পরে ঝগড়া করে। আজ কিছু বেশী ঝগড়া করেছে তাই তাদের বিচার করলাম। এছাড়াও অনেক কারামত লোকমুখে প্রকাশিত রয়েছে।

তিনি ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পাঙ্গাসিয়ায় সুনামের সাথে শায়খুল হাদিসের দ্বায়িত্ব পালনের পর নিজ গ্রামে চলে আসেন। গহরপুর জামেয়া প্রতিষ্টা করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল ব্যতিক্রম ধারার। প্রথমে দাওরাইয়ে হাদিস এরপর মিশকাত বা ফজিলত জামাত এমনি করে অন্যান্য শ্রেণী খোলা হয়। প্রতিষ্টাকাল থেকেই তিনি মাদ্রাসার মোহতামিম ও শায়খুল হাদিসের দ্বায়িত্ব পালন করেন। তাঁর এই প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার আলেমে দ্বীন দক্ষতার সাথে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করায় তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে দেশান্তরে। ১৯৯৬ সালে দেশের সর্ববৃহৎ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসীল আরাবিয়ার চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে নির্বাচিত করা হয় এবং মৃত্যু অবধি তিনি এ গুরু দায়িত্ব সুনামের সাথে পালন করেন। তিনি পাকিস্তান আমলে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। জমিয়তে উলামার নেতা হিসেবে ১৯৭০ এর জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। এসময় কালে তিনি তালিম, তারবিয়্যাত, তাযকিয়্যা, ইহসান, ওয়াজ-নসিহত ও সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।

ওফাত: ২০০৫ সালের ২৬শে এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেল ৪:১০ মিনিটে হাফিজ আল্লামা নুরউদ্দীন আহমদ গহরপুুরী (রহ.) ইহজগৎ ত্যাগ করেন। ওফাতকালে বয়স হয়েছিল (৮১) বছর। তিনি চার স্ত্রী, একমাত্র ছেলে হাফিজ মাওলানা মোসলেহুদ্দীন রাজু ও ৪ মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে যান। তাঁর জানাযায় হাজার হাজার ভক্তকুলের ঢল নেমেছিল। হুজুরের ওফাতের পর ভক্তরা কবরের মাটি নিতে শুরু করলে, মাটি রক্ষার্থে সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে হয়েছিল। বর্তমানে গহরপুরী (রহ.) এর একমাত্র পুত্র মুসলেহুদ্দীন রাজু ঐতিহ্যবাহী জামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুরের মোহতামিম হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।

গহরপুরী (রহ.)-কে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ: যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই বুযুর্গকে নিয়ে ইতোমধ্যে বিশাল একটি সমৃদ্ধ ও প্রামাণ্য স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে তার জীবন-কর্ম ও সাধনার নানা দিক। স্মারকগ্রন্থটির শুরুতে রয়েছে আল্লামা গহরপুরী (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী। নানা শ্রেণি-পেশার ২৪১ জনের লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে স্মারকগ্রন্থটি। দেশের প্রথম সারির আলেমদের বড় অংশের লেখা স্থান পেয়েছে এতে। এমপি-মন্ত্রী-মেয়রসহ সমাজের বিশিষ্টজনের লেখাও রয়েছে। ১২টি অধ্যায়ে বিভক্ত স্মারকগ্রন্থটিতে এ বুযুর্গ আলেমের জীবনের প্রায় সব দিকই উঠে এসেছে। পরিশিষ্টে ইংরেজি ও আরবিতে দুটি লেখায় তুলে ধরা হয়েছে এ মনীষী-আলেমের সংক্ষিপ্ত জীবনী।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!