কালুর আজ বিকাল থেকেই মন খারাপ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, পড়তে বসেও পড়ায় মন বসছে না। ক্লাস ওয়ানের ক্লাস শুরু হয়েছে সবে দশদিন। নতুন বইয়ের গন্ধটা ওর মন টানছে, কিন্তু তার থেকেও বেশি মন টানছে বিকালে জেঠু র জালে ধরা পড়া সেই বড়ো টিকটিকিটা।
তখন দুপুর বেলা। বাইরে আকাশে কালো করে মেঘ, তুফান, আর বৃষ্টি। কালু জানালা দিয়ে সেই বৃষ্টি দেখছিল। সামনেই ওদের বিরাট পুকুর। রাঙচিতার বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার খানিকটা দূরেই একটা বিশাল নদী। পুকুর পাড়ে অনেক গাছগাছালির পাতাগুলো কি সুন্দর বৃষ্টিতে স্নান করছে। তারই মধ্যে একটা বাঁদর খুব লাফালাফি করছে। হঠাৎ সেই বাঁদরটা কালুর জানালায় এসে কিচমিচ করে কি যেন বলে আবার চলে গেলো সেই পুকুর পাড়ের গাছে। একটা পেয়ারা পাতাশুদ্ধু ছিঁড়ে নিয়ে এসে কালুর জানালায় দিয়ে ইশারায় কি যেন বলতে চাইলো।
তারপর বারবার সে আসছিলো আর তাকে ঐ পুকুর পাড়ে যেতে বলছিলো। সেও চাইছিলো বৃষ্টিতে ভিজতে। চুপিচুপি সে কাউকে কিছু না বলে পুকুর পাড়ে চলে গেলো। সেখানে যা দেখতে পেলো, তাতে তার প্রথমে বেশ ভয় করছিলো। সে ছোট্ট ঘরে এসে তাড়াতাড়ি তার জেঠুকে ডেকে নিয়ে গেলো সেই পুকুর পাড়ে। জেঠুও সেখানে গিয়েই ভয় পেয়ে ঘরে এসে কাকে যেন ফোন করলো।
তারপরই এলো জেলে কাকু নিধু মালিক। কাঁধে একটা প্রকাণ্ড জাল নিয়ে সে চলে গেলো পুকুর পাড়ে।
সেখানে তখনো সেই বড়ো টিকটিকিটা পুকুরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেলে কাকু যে-ই না জালটা ফেলতে যাবে জলে অমনি টিকটিকিটা জলের কাছে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর জেলে কাকুর জালে সে গেলো আটকিয়ে। তারপর কালুর জেঠু, বাবা, ছোট কাকা, আর জেলে কাকু চারজন মিলে সেই জালটা তুলে আনলো পুকুর পাড়ে। ততক্ষণে কালুর ছোট পিসি ফোন করে কাদের যেন ডেকে এনেছে। তারা একটা বিরাট ট্রাকের ওপর একটা বড়ো লোহার গরাদ দেওয়া খাঁচা নিয়ে এসেছে।
বাড়ির সবাই তখন পুকুর পাড়ে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আট দশজন তাগড়াই চেহারার লোক সেই বড়ো টিকটিকিটার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে চেপে ধরলো, আর জেলে কাকু আস্তে আস্তে তার জালটা ছাড়িয়ে যেই না টিকটিকিটার মুখটা বের করেছে, ওমনি একটা লোক ইয়াব্বড় একটা আঁঠালো প্লাস্টিকের টেপ দিয়ে টিকটিকিটার মুখটা আটকে দিলো। কালুর মা কালুকে একটা কলা খেতে দিয়েছিলো, কালু সেটা টিকটিকিটাকে খেতে দেবে বলে নিয়ে এসে পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, সেটা আর সে খাওয়াতে পারলো না। মনটা সেই থেকে খারাপ হয়ে গেছে। লোকগুলো তারপর সেই টিকটিকিটাকে তার চারটে পা বেঁধে, কাঁধে তুলে নিয়ে সেই খাঁচাটার ভেতর চালান করে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।
সবাই কালুকে খুব আদর করে বলতে লাগলো, ভাগ্যিস কালু কাউকে কিছু না বলে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিল, আর বুদ্ধি করে জেঠুকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, নাহলে পুকুরের সব মাছ ঐ শয়তানটা খেয়ে নিতো, আর মানুষ জলে নামলে মানুষকেও গিলে খেতো।
কালু কিছুই বুঝতে পারছে না, ওরা কেন ঐ টিকটিকিটাকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলো। বাড়িতে রেখে দিলে সে পুষতে পারতো।
কালুর পড়ায় মন বসছে না। আনমনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে, আর ভাবছে সেই বাঁদরটাই বা কোথায় গেলো?
এমন সময় হঠাৎ তার গায়ে কি যেন একটা লাফিয়ে পড়লো। সে ভয় পেয়ে ছিটকে জানালা থেকে সরে এলো। পেছনে তাকিয়ে দেখে তার জেঠু হাসছে আর বলছে, এই দেখ তোর টিকটিকিটা। কালুর সামনে তখন একটা রাবারের টিকটিকি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কালুর মা তখন ঘরে এসে হাসছে আর বলছে, এইটুকু টিকটিকিতেই এতো ভয় পেয়েছিস তো, অতো বড়োটা হলে কি করতিস।
কালুর বাবা বললো, ওরে বুদ্ধুরাম ওটা টিকটিকির ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার দাদামশাই ছিলো। ওটা মানুষখেকো জীব- টিকটিকি নয়, কুমির। বুঝতে পেরেছিস?
কালু র তখন আর কোনো দিকে মন নেই, রাবারের টিকটিকিটা নিয়ে মহানন্দে খেলতে শুরু করেছে। বাড়ির সবাই তখন হাসছে আর বলছে, ভাগ্যিস কালু দেখে ছিলো, না হলে কি কাণ্ডটাই না হতো।